ডন প্রতিবেদক, লিয়াকত হোসেন, রাজশাহী : রাজশাহী জেলায় মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৮১ হাজার ৮১৫ হেক্টর। এবার আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর। অর্জন ৭৮ হাজার হেক্টর। ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের বরাদ্দকৃত সার নিয়ে চরম বিপাকে কৃষকরা। যেখানে অতিরিক্ত সার বরাদ্দের প্রয়োজন। এমন অবস্থায় বর্তমানে চরম সার সঙ্কটে পড়েছেন কৃষকেরা।
এই সার সঙ্কটে কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত চাহিদা থাকলেও সরকারের বরাদ্দকৃত সারও ঠিকমত পাচ্ছেন না কৃষকেরা। আবার সরকারের বরাদ্দকৃত সারও অপ্রতুল। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাচ্ছেন না ডিলারেরা। বরাদ্দের সার বণ্টনেও রয়েছে বৈষম্য। এদিকে গত ২৮ জুলাই কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক রাজশাহীতে এসে বলেছিলেন, ‘আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত দেশে সারের কোনও সমস্যা হবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন! আসছে আলুর সিজনে এই সঙ্কট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
ডিলারদের ভাষ্যমতে, তাঁরা জুলাই মাসের এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সারের বরাদ্দ এখনো পান নি। আগস্টের টাকাই জমা নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। জেলায় আগস্ট মাসের বরাদ্দ ৮ শ মেট্রিক টন। তা এখনো পান নি কৃষকেরা। আগস্টের বরাদ্দের সম্পূর্ণটাই বিএডিসি আমদানি করেছে। বিএডিসি বলছে ৮ শ মেট্রিক টনের মধ্যে ১৯০ মেট্রিক টন (১০ আগস্ট পযর্ন্ত) বণ্টন করা হয়েছে। অথচ কাগজ-কলমে রাজশাহী বিএডিসি গোডাউনে এমওপি মজুদ আছে ২ দশমিক ৮০ মেট্রিক টন। যদিও জুলাই মাসের এমওপি সার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি) আমদানি করেছে। তবুও বরাদ্দের আমদানিকৃত সার এখনো ডিলারেরা পাচ্ছেন না।
ফলে কৃষকরা সার না পেয়ে আমনের সিজনে চরম হুমকির মুখে পড়েছেন।
ডিলাররা আরও জানান, নতুন করে আলুর সিজেন শুরু হতে যাচ্ছে। সারের এই সঙ্কট নিরসন করা না গেলে আলু চাষও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের বরাদ্দকৃত সারের বাইরে আমদানি করা অতিরিক্ত সার আসতো বাজারে। বর্তমানে সেই সার না আসায় সঙ্কটটি আরও তীব্র হয়েছে। এমন অবস্থায় সরকারের অতিরিক্ত সার বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলেই মনে করছেন ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
জানা গেছে, সঙ্কট মোকাবিলায় ইতোমধ্যে অতিরিক্ত সার বরাদ্দ চেয়ে জেলা প্রশাসক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরাবর লিখিত আবেদন করেছে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহী জেলা ইউনিট। এদিকে এই সঙ্কটের মধ্যেও সার বণ্টনেও বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, তানোর উপজেলার কামার গা ইউনিয়নের আমন ধানের চাষযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর। সেখানে এমওপি বরাদ্দ ২১ মেট্রিক টন। অপরদিকে পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নে আমন ধানের চাষযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা ৬৫০ হেক্টর। সেখানে বরাদ্দ ২ দশমিক ৯ মেট্রিক টন এবং হরিয়ান ইউনিয়নে ৫৫০ হেক্টরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ দশমিক ২ মেট্রিক টন। এতে দর্শনপাড়ার অনেক কৃষক সরকারি বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার জন্য গত জুলাই মাসের এমওপি সার বরাদ্দ ছিলো ৯৪৭ মেট্রিক টন। এই সার বরাদ্দ করা হয়েছে গত ২১ জুন। বরাদ্দপত্রে বলা হয়েছে, এই সার সব সার ডিলারের মধ্যে সমহারে উপবরাদ্দ করে উপবরাদ্দের কপি আবশ্যিকভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। ডিলারেরা যাতে সঠিক সময়ে সার উত্তোলন করতে পারেন, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে আগস্ট মাসে ৮ শ মেট্রিক টন এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে গত ৭ জুলাই। এই সারের পুরোটাই বিএডিসির রাজশাহীতে। এই বরাদ্দের সার ডিলাররা এখনো পান নি। কৃষকেরা সার নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। এবার বাইরে থেকে সার ক্রয় করাও প্রায় অসম্ভব। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চারগুণ বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে। সেই কারণে আমদানিকারক ঠিকাদারেরা সার আমদানি করছেন না।
রাজশাহী বিএডিসি গোডাউনের সহকারী পরিচালক (সার) আরিফুজ্জামান বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, অফিসের কাজ অনেক। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগ্ম পরিচালক জুলফিকার আলীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
বিএডিসি রাজশাহীর যুগ্ম পরিচালক জুলফিকার আলীর অফিসে গিয়ে তাঁকে না পাওয়ায় ফোন করা হলে তিনি বাঙলা কাগজ ও ডনের কাছে দাবি করেন, ‘এই মুহূর্তে আমি বাহিরে আছি। বিকাল ৪টার পর ফোন দিলে এ বিষয়ে কথা বলবো।’
বিকেল ৪টার পর একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেন নি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপ-পরিচালক মোজদার হোসেনকে অফিসে না পাওয়ায় অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) তৌফিকুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, সরকারের বরাদ্দকৃত সার বিএডিসি গোডাউনে আছে। তাঁরা বরাদ্দকৃত সার ডিলারদের প্রদান করবেন। পূর্ব থেকে এইভাবে সার বরাদ্দ হয়ে আসছে।
এখন কেনো সঙ্কট দেখা দিয়েছে, ‘তার কারণ হিসেবে’ তিনি বলেন, সরকারের বরাদ্দের বাহিরেও সার আমদানি করতো অনেকে, যা এখন বন্ধ আছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেশি। তাই অনেকে সার আমদানি করছে না। ইতোমধ্যে অতিরিক্ত সার বরাদ্দ চেয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে যে আবেদন আমার কাছে এসেছে, সেটি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমি পাঠিয়েছি, অতিরিক্ত বরাদ্দ পেলে এই সঙ্কট নিরসন হবে। তবে এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট বলছে, যতোটা সঙ্কট শোনা যাচ্ছে, ততোটা সঙ্কট আসলে নেই।